(Vande Mataram) বন্দে মাতরম: বিপদের সামনে বিচলিত হতেন না, ছদ্মবেশী মাস্টারদা সূর্য সেন আজও মিথ (Masterda Surya Sen)
- (Vande Mataram) বন্দে মাতরম: বিপদের সামনে বিচলিত হতেন না, ছদ্মবেশী মাস্টারদা সূর্য সেন আজও মিথ (Masterda Surya Sen) - October 19, 2023
- বাবুতন্ত্র- দাম্পত্যে পলিটিক্স - November 1, 2018
- বাবুতন্ত্র – বঙ্কিমি স্তোত্র - September 11, 2018
(Chittagong Armoury Raid) চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন-স্বাধীনতার ‘সূর্য’ দেখিয়েছিলেন মাস্টারদা সূর্য সেন
সেটা ১৮৯৪ সাল। ২২ মার্চ চট্টগ্রামে জ্নমগ্রহণ করেন সূর্য সেন। কে জানত আগামী দিনে এই মাস্টারদা সূর্য সেনই ব্রিটিশ রাজের রাতের ঘুম কেড়ে নেবেন?
সূর্য সেনের বাড়ি ছিল চট্টগ্রামের নোয়াপাড়া গ্রামে। স্কুলের পাঠ শেষ করে বহরমপুর কলেজে ভর্তি হন সূর্য সেন।ধীরে ধীরে অধ্যাপক সতীশচন্দ্র সেনের সান্নিধ্যে আসেন।ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বিপ্লব নিয়ে নানা প্রশ্নের উত্তর পান অধ্যাপক সতীশচন্দ্র সেনের কাছে। বিপ্লবী মন্ত্রে দীক্ষা পান। যোগ দেন গুপ্ত বিপ্লবী দলে। এরপর উমাতারা উচ্চ ইংরাজি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। দীর্ঘদিন সেই শিক্ষকতার কাজ করে যান সূর্য সেন।সকলের শ্রদ্ধা অর্জন করে হয়ে ওঠেন মাস্টারদা। মাস্টারদা সূর্য সেন।
১৯২১ সাল।গান্ধীজী অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেছেন। সেই আন্দোলনে অংশ নেন মাস্টারদা। আন্দোলন সফল হল কোথায়? আবার বিপ্লবী কাজেই সক্রিয় হয়ে ওঠেন মাস্টারদা সূর্য সেন।চুপিচুপি গড়ে তোলেন গুপ্ত সমিতি।কেউ যাতে ঘুণাক্ষরেও জানতে না পারে। সেই গুপ্ত সমিতির নাম দেব সম্যাশ্রম।
সেটা বাংলার ২৮ অগ্রাহয়ণ, ১৩৩০ সন। ইংরাজি ১৯২৩ সাল, ১৪ই ডিসেম্বর। শুক্রবার। চট্টগ্রাম শহরে সরকারি টাকা লুট হয়। বাটালি পাহাড় এলাকা লুট হয় সরকারি রেলের টাকা। অভিযানে ছিলেন অনন্ত সিং, গণেশ ঘোষ, দেবেন দে ও নির্মল সেন।
কিন্তু হঠাৎ রেল ডাকাতি কেন? বিপ্লব চাই বিপ্লব। তারজন্য চাই অস্ত্র।সশস্ত্র আন্দোলন করতে হবে। রেল ডাকাতির ১৭হাজার টাকায় অস্ত্র কিনতে হবে। কলকাতায় গেলেন অম্বিকা চক্রবর্তী ও দলিলুর রহমান। ততক্ষণে অনন্ত সিং ও গণেশ ঘোষের নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়ে গেছে।
মামলায় নাম উঠল মাস্টারদা সূর্য সেন ও অম্বিকা চক্রবর্তীরও। মামলায় আসামীপক্ষের আইনজীবী হয়ে লড়াই করেন কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত।সে যাত্রায় অবশ্য রক্ষা মেলে। মামলা থেকে ছাড়া পেলেন মাস্টারদা সূর্য সেন ও অম্বিকা চক্রবর্তী।
১৯২৪ সাল। এক অর্ডিন্যান্স জারি করে ব্রিটিশ প্রশাসন।সারা বাংলায় বিপ্লবীদের ধরপাকড় শুরু হয়। শুধু এক ২৫ অক্টোবর তারিখেই বাংলার বিভিন্ন জেলা থেকে গ্রেফতার করা হয় প্রায় ২০০ জন বিপ্লবীকে। সেই দিনই গ্রেফতার হন গণেশ ঘোষ, নির্মল সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী, অনন্ত সিং। তবে সেদিন মাস্টারদার নাগালই পায়নি ব্রিটিশ পুলিশ।
খোঁজ খোঁজ খোঁজ, কোথায় মাস্টারদা? চট্টগ্রাম ছেড়ে সূর্য সেন তখন কলকাতার শোভাবাজারে গা ঢাকা দিয়েছেন। ওই সময় দক্ষিণেশ্বরে বোমা তৈরির প্রশিক্ষণও নিচ্ছিলেন। দক্ষিণেশ্বরের গোপন ডেরা আর গোপন থাকেনি। সেই বোমা তৈরির কারখানায় হানা দেয় পুলিশ। সূত্র ধরে ধরে শোভাবাজারের ৩ তলা বাড়ির বিপ্লবী আশ্রয়ের সন্ধান মেলে। তারপর আর কি? পুলিশ হানা দিল শোভাবাজারের সেই বাড়িতে।
১৯২৫ সালের ১০ নভেম্বর। বাইরে পুলিশ বাড়ি ঘিরে ফেলেছে, আর ভিতরে তখন মাস্টারদা সূর্য সেন। কী হয়, কী হয়! মুহূর্ত চিন্তা করলেন, জামা খুলে রেখে কাঁধে গামছা নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন মাস্টারদা। সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে এলেন।বাইরে আটকাল দুই পাহারাদার। এতটুকু বিচলিত হলেন না মাস্টারদা। বললেন, আমি চাকর। বাবুদের জন্য খাবার আনতে যাচ্ছি। পাহারাদাররা ছেড়ে দিলেন।
কাছাকাছি ছিলেন এক আইবি অফিসার। খবরটা তাঁর কানেও গেছে। পাহারাদারদের জিজ্ঞাসা করলেন, খালি গায়ে লোকটা কোথায় গেল? ততক্ষণে হাওয়াতেই যেন মিশে গিয়েছেন মাস্টারদা!
এই ঘটনার প্রায় এক বছর পর গ্রেফতার হন মাস্টারদা। ১৯২৬ সালের ৮ অক্টোবর। আমহার্স্ট স্ট্রিটের এক মেসে গা ঢাকা দিয়েছিলেন সূর্য সেন। সেখান থেকেই তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। শুরু হয় মুরারিপুকুর ষড়যন্ত্র মামলা।
মাস্টারদা কি মন্ত্র জানতেন?
অনেকের ধারণা ছিল, মাস্টারদা মন্ত্র জানেন! হাওয়ার সঙ্গে মিশে যেতে পারেন, তাই পুলিশ ধরতে পারে না! মাস্টারদা মন্ত্র জানতেন। বিপ্লবী মন্ত্র।
সেই সময় মাস্টারদার ‘গোপন জীবন’ নিয়ে নানা গল্প মুখে মুখে ফিরত। অধিকাংশই পুলিশের চোখে ধূলো দেওয়ার গল্প। কেউ বলেন, মালি সেজে গ্রেফতারি এড়িয়েছেন। আবার কেউ নাকি মাস্টারদাকে সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশেও দেখেছেন। মাস্টারদা যেন মিথ!
১৯৩০ সাল, ১৮ এপ্রিল। চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার লুন্ঠন হল। পুরোদমে চলছে ধরপাকড়। কলকাতা ও চন্দননগরে কয়েকজন ধরা পড়লেন। ব্রিটিশ পুলিশের ধারণা হল, মাস্টারদাও কলকাতার দিকেই কোথাও গা ঢাকা দিয়েছেন। চট্টগ্রামে বা তার আশেপাশে কোথায় লুকিয়ে থাকবেন, এমন সন্দেহ কোনও গোয়েন্দার মাথাতেও এসেছিল কি?
ব্রিটিশ সরকার মাস্টারদার মাথার দাম বাড়িয়ে দিল। জীবিত অথবা মৃত মাস্টারদাকে চাইই চাই। কড়কড়ে ১০ হাজার টাকা পুরস্কার। তখন ফেরারি সূর্য সেন কোথায়? কোথায় আবার চট্টগ্রামে। একেবারে শহরে না থাকলেও চট্টগ্রাম লাগোয়া এগ্রাম ওগ্রামে ডেরা বদলে লুকিয়ে রয়েছেন। যাবতীয় গতিবিধি চট্টগ্রাম শহরের কুড়ি-বাইশ কিলোমিটারের মধ্যেই। পুলিশের নাকের ডগায়।
ব্রিটিশ পুলিশও সতর্ক। ছোট ছোট ২-৩টে গ্রাম ধরে একটি সশস্ত্র পুলিশ পিকেট, কোথাও আবার সামরিক বাহিনীর ঘাঁটি তৈরি করা হল। গ্রামে কাউকে দেখে সন্দেহ হলেই ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে চলত জিজ্ঞাসাবাদ। গ্রামের ১৬ থেকে ৪০- সব পুরুষদের কার্ড দেওয়া হত। ৩ রকম কার্ড-লাল, গোলাপি ও সাদা। মানে, রাজনৈতিক বিপজ্জনক, একটু কম বিপজ্জনক আর যাদের দেখে তেমন কিছু সন্দেহ হয় না।
পুলিশ তন্নতন্ন করে খুঁজে বেড়াচ্ছে। আর মাস্টারদা কখনও দোয়ারিবাড়ির দুর্ভেদ্য সুপারি জঙ্গলে, কখনও জৈষ্ঠ্যপুরা কবিরাজ অশ্বিনী দে-র বাড়ি আবার কখনও পোপাদিয়ায় মুসলমান চাষির বাড়িতে আশ্রয় নিচ্ছেন। আত্মগোপন করতে কোনও গ্রাম বা আশ্রয়স্থল খুঁজতে হত না, প্রাণের প্রিয় মাস্টারদাকে লুকিয়ে রাখতে গ্রামের পর গ্রাম যেন দরজা খুলেই রেখেছে। মাস্টারদা আশ্রয় নিলে যেন সেই বাড়ির সকলে ধন্য হয়ে যাবে।
একদম সাধারণ চেহারা। আর সাধারণের মধ্যে মিশে যাওয়ার অদ্ভূত ক্ষমতা। কখনও ঝাঁকামুটে, কখনও তিনিই আবার মাঝি, খালি গায়ে তিলককাটা পুরোহিত সাজেও মাস্টারদাকে ধরবে কার সাধ্যি আছে! এমনকী মহিলার ছদ্মবেশেও পুলিশের চোখে ধূলো দিয়েছেন সূর্য সেন।
দিনের পর দিন লুকিয়ে বেড়াচ্ছেন, অথচ বিপ্লেবর কাজ থেমে নেই। দলে নতুন নতুন রিক্রুটও চলছে, আবার নতুন পরিকল্পনাও চলছে। ডিনামাইট ষড়যন্ত্র, পাহাড়তলির ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণ, সবই তো মাস্টারদার পরিকল্পনা অনুসারে। তবে বিপদও যেন তাড়া করে বেড়িয়েছে। ১৯৩২ সালের জুন মাসের মাঝামাঝি। ধলঘাট গ্রামে লুকিয়ে মাস্টারদা। সঙ্গে নির্মল সেন ও অপূর্ব সেন। ধলঘাটের গোপন আস্তানায় তখন দেখা করতে এসেছিলেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। ১৩ জুন। হঠাৎ বিপদ! বাড়ির বাইরে ফোর্স। রিভলবার নিয়ে দাঁড়িয়ে খোদ ক্যাপ্টেন ক্যামারন। তারপর তুমুল গুলির লড়াই। কোনও মতে পালালেন মাস্টারদা ও প্রীতিলতা। কিন্তু সেদিনই শহিদ হলেন নির্মল সেন ও অপূর্ব সেন।
বিপদ যেন পিছনই ছাড়ছে না। ১৯৩৩ সাল। গৈরালা গ্রামে আশ্রয় নিলেন মাস্টারদা। ৫ মাইল দূরে পটিয় থানা। গৈরালা গ্রামের ক্ষিরোদপ্রভা বিশ্বাসের বাড়ির গোপন আশ্রয়ে মাস্টারদা। দেখভাল করছেন ব্রজেন সেন। গ্রামেই বাড়ি। গোপন ডেরার দেখভালের দায়িত্ব ব্রজেন সেনের উপর। মাস্টারদার
সঙ্গে রয়েছেন মণি দত্ত, শান্তি চক্রবর্তী, সুশীল দাশগুপ্ত ও কল্পনা দত্ত।
রোজ খাবার তৈরি হয় ব্রজেন সেনের বাড়িতে। রাঁধেন তাঁর বৌদি। তারপর সেই রান্না করা খাবার ক্ষিরোদপ্রভার বাড়িতে আনেন ব্রজেন সেন।
রোজ কার খাবার নিয়ে যায় ব্রজেন? লুকিয়ে পিছু নেয় ব্রজেনের দাদা নেত্ররঞ্জন সেন। নেত্র সেন জমিদার, কিন্তু তখন দেনায় আকন্ঠ ডুবে। টাকার খুব দরকার। আর মাস্টারদার মাথার দাম ১০ হাজার টাকা। পুলিশে খবর দেয় নেত্র সেন।
১৯৩৩ সাল ১৬ ফেব্রুয়ারি। রাতের অন্ধকারে বাড়ির বাইরে লন্ঠন দুলিয়ে পুলিশকে সঙ্কেত দেয় নেত্র সেন। তখন সূর্য সেনের সঙ্গেই ব্রজেন। আলো দেখে বুঝতে ভুল করেননি, কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। ক্যাপ্টেন ওয়ামসলির নেতৃত্ব বাড়ি ঘিরে ফেলেছে গুর্খা সেনা। ৩ দলে ভাগ হয়ে পালানোর চেষ্টা করেন বিপ্লবীরা। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। পুলিশের হাতে ধরা পড়লেন মাস্টারদা। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের ২ বছর ৮ মাস পর।
আরও bengalism: গোপন ডেরায় মাস্টারদার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ, পুরুষের ছদ্মবেশে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার