MADLY ENOUGH

বাবুতন্ত্র- দাম্পত্যে পলিটিক্স

স্বামী-স্ত্রী দু্’জনেই কুস্তি জানলে শত ঝগড়াতেও ডিভোর্স হয় না। বরং দুর্ধর্ষ ‘খুনে’ প্রতিদ্বন্দ্বীর সামনে ঠেলে দিতে স্বামীকে হেব্বি বার খাওয়ায় অর্ধঙ্গিনী। সলমন খানের সুলতান সিনেমাতে তো তেমনটাই আছে। বউ সেন্টু দিল, আর অমনি সলমন খান ‘সুলতানি’ বুদ্ধিতে মই বেয়ে গাছে উঠে পড়ল। মোদ্দাকথায় সুলতানের ক্লাইম্যাক্স এমনই দাম্পত্যময় ভাব বিনিময়ের বুনোটে ঠাসা। গোঁয়ার সুলতান ও অভিমানী আর্ফার এই গল্পই শুধু নয়, আমার আপনার সংসারের কাহিনিও কিন্তু দাম্পত্য রাজনীতির কথাও বলে।

দাম্পত্যেও রাজনীতি! প্রবন্ধের বিষয় প্রস্তাবে আপত্তি থাকতেই পারে। সংসারে রাজনীতি ঢুকিয়ে দেওয়ার বিরোধিতা করে সেক্ষেত্রে প্রতিবাদ মিছিল বের করে দিলেই হয়! কিন্তু বাপু রাজনীতি যদি নাই থাকবে, তাহলে সংসারে ভাঙন লাগছে কেন? পরিসংখ্যান বলছে, খাস কলকাতায় ১০ বছরে ডিভোর্স মামলা বেড়েছে ৩৫০%।

দ্বারষষ্ঠী কাঁটাকে প্রণাম করে স্ত্রী আচারস্থলে যেতে যেতে নাকমলা, কানমলা খেয়ে তবে গিয়ে নতুন বউয়ের সঙ্গে খুনসুটি শুরু হয়। ‘কড়ি দে কিনলেম, দড়ি দে বাঁধলেম, হাতে দিলাম মাকু, একবার ভ্যাঁ করতো বাপু’… চেনা রীতির বিয়েতে স্ত্রী আচারে আহ্লাদিত হওয়া যায়, কিন্তু দাম্পত্যে ‘ভ্যাঁ’টা কিন্তু থেকেই যায়। ‘গৃহপালিত’ হয়ে ওঠাই এক নব্য স্বামীর পরাকাষ্ঠা। দ্বিমত থাকতেই পারে। কিন্তু সেই মত পার্থক্যের সমর্থনে আপত্তি উচ্চারিত হয়, ঝগড়ার যুক্তি তাতে থাকে না। নতুন সংসারে এক নিঃশর্ত আত্মসমর্পন থাকে। ভবিষ্যতের স্বপ্নই সেখানে প্রধান, রাজনীতির উপস্থিতি তো সেখানে অবাঞ্ছিত। হতে পারে সংসারের বয়স বাড়তে থাকলে শর্তাধীন সহাবস্থানে গা সইয়ে নিত হয়, তা বলে রাজনীতি!

ইয়ে, মানে… বন্ধুর বাড়িতে খেলা দেখতে যাবেন বলে স্ত্রীকে শপিংয়ে নিয়ে যাওয়াটা পোস্টপন করতে পারবেন? বা ধরুণ, স্ত্রী বললেন পিজ্জা আর আপনি বললেন আলুর চপ- দেখবেন বেলাশেষে যুদ্ধটা জিতবেন আপনার অর্ধাঙ্গিনী। কারণ, অগ্নিসাক্ষী করা স্ত্রীর কৌশলী বাক্যবাণের কাছে আপনার লাখো যুক্তির গো হারা হার। রাজনীতি এটাই। হয়ত এই উদাহরণটা সূক্ষ্ম। গোদা উদাহরণও আছে। যেমন, উইকেন্ডে বাপের বাড়ি না শ্বশুরবাড়ি, নতুন ফ্ল্যাটে শ্বশুর-শাশুাড়ির ফোটোগ্রাফ না থিম ওয়াল ইত্যাদি। স্বামী, স্ত্রী ও সন্তানের নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির ক্ষেত্রে এটা Interfamily Politics। এই সংসারে যদি শাশুড়িকে অন্তর্ভূক্ত করা হয়, তাহলে তো কথাই নেই। সমাজবিজ্ঞানীরাও মানবেন, শাশুড়ি ও পুত্রবধূর সম্পর্ক সাধারণত ব্যস্তানুপাতিক। যে কোনও ইস্যুতেই উপরোক্ত দুই পক্ষ মতৈক্যে আসতে চান না। আপনি হস্তক্ষেপ করতে চাইলে আপনাকে দেগে দেওয়া হবে ‘মামাজ বয়’, আর অন্য পক্ষ বলবে ‘স্ত্রৈণ’।

দাম্পত্য রাজনীতি কিন্তু হালের আমদানি নয়, মহাভারতের সময়েও ছিল। যদি বলি করেণুমতী কে? চেদিরাজকন্যা করেণুমতী নকুলের সহধর্মিনী। পাঞ্চালী ছাড়াও পাণ্ডবদের আরও ন‍’জন স্ত্রী ছিলেন! অথচ মহাভারত জুড়ে শুধু দ্রৌপদী। অন্যদের ছাপিয়ে সব সময় প্রধান চরিত্র হয়ে থাকাটাও রাজনীতি। বৃহত্তর Family Politics-এ দ্রৌপদী এক আইকন। পাশাখেলায় হেরে রাজ্যত্যাগের পর পাণ্ডবরা তখন দ্বৈতবনে। দ্রৌপদী এমন গোঁসা করেছিলেন যে ঘুম ছুটে গিয়েছিল বীর পঞ্চপাণ্ডবের। ঋষিমুনিদের পরামর্শতেও কাজ হয়নি। মান ভাঙানোর কৌশল ঠিক করতে শ্রীকৃষ্ণর শরণাপন্ন হতে হয়েছিল ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরদের।

গ্রিক শব্দ Polis থেকেই এসেছে Politics। সামগ্রিক রাষ্ট্রের ভাবনা হল Polis। The Republic-এ আদর্শ রাষ্ট্রের বর্ণনা করেছেন প্লেটো। সমাজ যত সভ্য হয়েছে, মানুষ বুঝেছে আদর্শ রাষ্ট্র অনেকটা সোনার পাথরবাটির মত। তবে আদর্শ আকর বলে তো কিছু একটা থাকে। আদর্শ সমাজ গঠনের লক্ষ্যও থাকে। সেই সূত্রেই সমাজে ঢুকে পড়েছে Politics। রাজনীতি একটা প্রয়াস। আরও ভাল থাকার চেষ্টা। মানুষ নিজের ইচ্ছা, ভাবনা, লক্ষ্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। কিন্তু সমাজের সকল মানুষের সঙ্গে সেই ভাবনা-চিন্তা মেলে না। তখনই বাধে দ্বন্দ্ব। সেই দ্বন্দ্ব নিরসন বা কোনও নির্দিষ্ট ভাবনাকে অন্যকে মানিয়ে নেওয়ানোর উপায়ই হল রাজনীতি। ঝাণ্ডা হাতে শুধু তৃণমূল সিপিএম নয়। লোকসভা, বিধানসভা ভোটের বাইরেও রাজনীতি থাকে। একের অধিক মানুষ থাকলে, আর তাদের কিছুর ভাবনায় মতের মিল হলেই রাজনীতি শুরু হয়ে যায়। তখন অপর গ্রুপ বা বিরোধী মতের মানুষটিকে নিজের মত মানতে বাধ্য করানোটাই রাজনীতি। ‘What is Politics?’ বইতে সমাজের প্রাথমিকস্তরে রাজনীতির উপস্থিতির কথা বলেছেন Leftwich। লিখেছেন, “ Politics I take to be the activity of attending to the general arrangements of a set of people whom chance or choice have brought together. In this sense, families, clubs and learned societies have their politics.” সমাজের প্রাথমিক উপাদান সংসার তাহলে কী করে রাজনীতি রহিত হয়? খোদ অ্যারিস্টটল বলে গেছেন, “ Man is by nature a political animal.”

আসলে অরাজনৈতিক বলে কিছু হয় না। সংসারে মায় দাম্পত্যের পরতে পরতে রাজনীতির অধিষ্ঠান। ক্ষমতা মানেই রাজনীতি। দর্শনশাস্ত্র বলে, ক্ষমতা হল সম্পর্কের এক বিশেষ প্রকাশ। সংসারে স্বামী ও স্ত্রী– দু’জন মানুষ থাকবে, একের সব মতই কি অন্যে বিনা প্রশ্নে মেনে নেবে! ফুলশয্যার রাতে ঘোমটা তুলে নতুন বউকে আ তু তু আদর বাঙালির অচেতন মনে গাঁথা আছে। সিনেমা দেখে দেখে এই সিনটা মুখস্থ হয়ে গেছে। কিন্তু সমস্যা এর পরের দিন থেকে। রোমান্সের ফাঁকে ফাঁকেই সম্পর্কের জ্ঞাপন তার নির্মাণ-বিনির্মাণ চালিয়ে যায়। ভাঙা-গড়ার টানাপোড়েনে ভারসাম্য বেসামাল হলে ডিভোর্স একপ্রকার নিশ্চিত। ২০০৩ সালে কলকাতায় ২, ৩৩৮টি ডিভোর্স মামলা হয়। ১০ বছরের মধ্যে সেই সংখ্যা সাড়ে ৩ গুণ বেড়ে গেছে। ২০১৪ সালে প্রথম ১১ মাসে (৩০ নভেম্বর পর্যন্ত) এই শহরে ৮৩৪৭টি ডিভোর্স মামলা দায়ের হয়। কিন্ত কেন সংসার সুস্থিত হচ্ছে না? কেউ কেউ আঙুল তুলবে স্ত্রীর দিকে। বলবে, এখনকার মেয়েরা অনেক বেশি স্বাধীনচেতা, VOCAL। কিন্তু তলিয়ে দেখলে ধরা পড়বে একে অপরের মত, ভাবনা মানিয়ে নিতে পারছেন না স্বামী-স্ত্রী। এটা ইগোর লড়াই। ইগো থেকেই তৈরি হচ্ছে আরও জটিল সমস্যা।

তবে সুখবর শুনিয়েছে ভোপালের বরকাতুল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। ইন্টারডিসিপ্লিনারি স্টাডিজে তারা চালু করছে ‘আদর্শ বধূ’ বা ‘মডেল বৌমা’ কোর্স। ৩ মাসের এই কোর্সের শেষে সার্টিফিকেট দিয়ে আবারও প্রমাণ করা হবে ‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে’। আসলে ক্ষমতার ভরকেন্দ্রের পুনর্বিন্যাসই সংসারে যত অশান্তির মূল। তাই কোর্স শুরুর আগেই বরকাতুল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডি সি গুপ্তা বলে দিয়েছেন, “ এই কোর্স শাশুড়ি-বৌমার সম্পর্ক বিষয়ক নয়, সংসারকে ভাঙনের হাত থেকে ঠেকানোই এর লক্ষ্য। ” কোর্সের খবর শুনে নারীবাদীরা বলছেন, যত দায় কি মেয়েদের ? এই কোর্স পুরুষতান্ত্রিকতাকেই উৎসাহ দেবে।

আম পাবলিকের জীবন সিনেমা নয়। সেখানে সুরজ বরজাটিয়ার সিনেমার মত ভিলেনরা শেষ সিনে ভাল হয়ে যায় না। সেখানে প্রতি মুহূর্তেই বাঁকা হাসি খোঁচা মারে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, মুখাবয়বের বিভিন্ন অভিব্যক্তির মধ্যে হাসিই হল সব থেকে প্রতারণাপূর্ণ। অথচ ভাবের বিনিময়ে হাসি এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেয়। শান্ত হাসি, মিষ্টি হাসি, ব্যঙ্গের হাসি–বিজ্ঞানীরা গুনে দেখেছেন, একজন মানুষ প্রায় ১৮ রকমের হাসির অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন। তারমধ্যে মাত্র একটিতেই লুকিয়ে থাকে সততা, প্রকাশ পায় নির্ভেজাল আনন্দ। ফরাসি নিউরোলজিস্টের নামে সেই হাসির নাম Duchenne হাসি। দাম্পত্যে রাজনীতি থাকলেও, দুচেনে হাসি একেবারেই হারিয়ে যায়নি। হাজার হোক রাজনীতি তো। দাম্পত্যের রাজনীতিতে জমাট প্রেমও তো থাকে!

Diptatanu Banerjee

diptatanu.banerjee@gmail.com

Recent Posts

(Vande Mataram) বন্দে মাতরম: বিপদের সামনে বিচলিত হতেন না, ছদ্মবেশী মাস্টারদা সূর্য সেন আজও মিথ (Masterda Surya Sen)

মাস্টারদা কি মন্ত্র জানতেন? অনেকের ধারণা ছিল, মাস্টারদা মন্ত্র জানেন! হাওয়ার সঙ্গে মিশে যেতে পারেন,… Read More

7 months ago

(Jai Hind) গোপন ডেরায় মাস্টারদার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ, পুরুষের ছদ্মবেশে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার (Pritilata Waddedar)

কল্পনা দত্ত তাঁকে পরিচয় করিয়ে দিলেন মাস্টারদা সূর্য সেনের সঙ্গে। মাস্টারদার সঙ্গে এটাই প্রথম দেখা… Read More

10 months ago

(Jai Bangla) বাঙালির অপমানের জবাবে বুকে রোলার তুলেছিলেন মহেন্দ্রনাথ

বাঙালিকে অপমান! গুরুর নির্দেশে নতুন খেলা দেখাতেই হবে। বুকে ১৬২ মণের রোলার তুললেন সার্কাস বিখ্যাত… Read More

11 months ago

(Vande Mataram) বন্দেমাতরম: বাংলার প্রথম গুপ্ত বিপ্লবী দল খুলতে সাহায্য করেছিলেন সরলা দেবী (Sarala Devi Choudhurani)

রবীন্দ্রনাথের ভাগ্নী সরলা দেবী ছোট থেকেই জাতীয়তাবাদে অনুপ্রাণিত। লিখেছেন শতাধিক স্বদেশপ্রেমের গান। স্বদেশী আন্দোলনের অংশ… Read More

5 years ago

(Vande Mataram) বন্দেমাতরম: ছাদ লাফিয়ে ঘরে ঢুকে গোপন নথিতে আগুন দিয়েছিলেন পারুল (Parul Mukherjee)

অনুশীলন সমিতির বিপ্লবী অমূল্য মুখোপাধ্যায়ের বোন পারুল। টিটাগড় ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেফতার পারুলের পেট থেকে কথা… Read More

5 years ago

(Banglar Siksha)শশীপদর স্কুলের প্রথম ছাত্রী স্ত্রী রাজকুমারী

‘বেলেল্লাপনার এক শেষ!’ লোকনিন্দা উড়িয়ে সেদিন স্বামী শশীপদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে লেখাপড়া শিখেছিলেন স্ত্রী রাজকুমারী। স্ত্রীর… Read More

5 years ago