‘ বামুনের ছেলে সার্কাস দেখাবে, তাও আবার বাঘ নিয়ে! সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণবংশের সন্তানের কি সেই কাজ সাজে, তারওপর হিংস্র জন্তুদের নিয়ে খেলা দেখানোয় ঝুঁকিও কম নয়।’ পিতৃদেবের শত আপত্তি উড়িয়েই সার্কাস দল করেছিলেন শ্যামাকান্ত।
শশীভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন ত্রিপুরা রাজস্টেটে সেরেস্তাদার। তাঁরই ছেলে শ্যামাকান্ত। ১৮৫৮ সালে এখনকৈর বাংলাদেশের বিক্রমপুরের আরিয়াল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ছোট থেকেই শরীরী কসরতের দিকে তাঁর ঝোঁক। কলেজে পড়ার সময় ব্যায়ামচর্চাতেই অধিকাংশ সময় ব্যয় করতেন তরুণ শ্যামাকান্ত। কুস্তিতে অনেক পালোয়ানকে হারিয়েও দিতেন।
ইচ্ছা ছিল সেনাবাহিনীতে যোগ দেবেন। কিন্তু সেই স্বপ্ন সফল হয়নি। ত্রিপুরার রাজা বীরচন্দ্র মাণিক্য যুবক শ্যামাকান্তকে পার্শ্বচর নিযুক্ত করেন। দু্’বছর ত্রিপুরা রাজার কাছে কাজ করে বরিশালে জেলা স্কুলের ব্যায়াম শিক্ষকের চাকরি নেন। এই চাকরি করতে করতেই সার্কাস দল গড়ার পরিকল্পনা করেন শ্যামাকান্ত।
শ্রীহট্টের সুনামগঞ্জে বন থেকে ধরা পড়া চিতা কেনেন শ্যামাকান্ত। কিন্তু কিছুতেই বাগে আনতে পারছিলেন না সেই চিতাকে। সারা শরীরে নখের ক্ষত, রক্ত—তবু হাল ছাড়তে নারাজ শ্যামাকান্ত। প্রায় দু’মাসের চেষ্টায় সেই চিতা বশ মানল। বাঘের খেলা দেখিয়ে নাম করলেন শ্যামাকান্ত।
বাঘ, সিংহ সহ নানা হিংস্র জন্তুর খেলা দেখাতেন শ্যামাকান্ত। ১৮ বছর বাঘ সিংহের খেলা দেখিয়েছেন তিনি। খেলা দেখাতে গিয়ে বেশ কয়েকবার সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখ থেকেও ফিরতে হয় তাঁকে। সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের সঙ্গে খেলা। রয়্যাল বেঙ্গলের খাঁচায় ঢুকতেন শ্যামাকান্ত। প্রবল গর্জন করে ছুটে আসত রয়্যাল বেঙ্গল। বাঘের মুখে ডান হাত ঢুকিয়ে রয়্যাল বেঙ্গলকে আলিঙ্গন করতেন শ্যামাকান্ত। এই দৃশ্য দেখে দর্শকদের কেউ আতঙ্কিত, কেউ বিস্মিত।
বাঘ, সিংহ ছাড়াও বুকের উপর প্রকাণ্ড পাথর রেখেও খেলা দেখাতেন শ্যামাকান্ত। ১০ মণ ওজনের পাথর বুকে রাখতেন। আর হাতু়ড়ি দিয়ে সেই পাথর ভাঙা হত। একবার লাটভবনে ১৪ মণ পাথর বুকে নিয়ে খেলা দেখান শ্যামাকান্ত। কয়েকজন গোরা সেনা হাতুড়ি মেরেও সেই পাথর ভাঙতে পারেনি। ইংরেজি, বাংলা সব কাগজে বীর শ্যামাকান্তের খবর বেরোতে লাগল। তৎকালীন এক কাগজে লিখল, “ পদে মস্তকেতে উচ্চ উপাধান, অবশিষ্ট দেহ শূন্যেতে রয়। ঐ যুবা এক রয়েছে শয়ান, হেন অবস্থায় বিশাল প্রস্তর দিয়াছে যুবার বক্ষের উপর , লৌহময় এক ধরিয়া মুদগর সবলে অপরে আঘাত করে। অদ্ভূত ব্যাপার, ভাঙ্গিল প্রস্তর! ব্যথিত না হ’লো বীরের দেহ ! দৈত্য কি দানব হবে এই নর! অসুর বিনা এত পারে কি কেহ ?”
এক সময় হাতি, পাঁচটি বাঘ, কুকুর, বাঁদর, ভল্লুক প্রভৃতি জন্তু নিয়ে Grand Show of Wild Animals নামে সার্কাস দল বানান শ্যামাকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়।
শেষ জীবনে সন্ন্যাস নেন ব্যাঘ্রবীর শ্যামাকান্ত। সন্ন্যাসী তিব্বতী বাবা তাঁর নাম দেন সোহহং স্বামী। নৈনিতালের ভাওয়ালীতে মৃত্যু হয় ব্যাঘ্রবীর শ্যামাকান্তর।